যথেচ্ছ ব্যবহারে অ্যান্টিবায়ােটিক রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে রােগী ঠেকাতে আসছে নতুন আইন। প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়ােটিক বিক্রিতে ২০ হাজার টাকা জরিমানার প্রস্তাব অ্যান্টিবায়ােটিক চেনাতে মােড়কে লাল রং
যশােরের রাজিউর রহমান (৫২) সড়ক দুর্ঘটনায় পায়ে।
আঘাত পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন মাস দুয়েক আগে। হাঁটুর নিচের অংশ ভেঙে ও থেঁতলে যাওয়ায় তার অপারেশন করেন চিকিৎসক। কিছুদিন পর ওই জায়গায় ইনফেকশন হলে বাধে বিপত্তি। কোনাে অ্যান্টিবায়ােটিকই কাজ করেনি তার শরীরে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার। ডা. তুষার মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই রােগীর পায়ে ইনফেকশন হলে আমরা অ্যান্টিবায়ােটিক দিই।
কিন্তু দেখা যায়, অ্যান্টিবায়ােটিক তার শরীরে কাজ। করছে না। ২০টি অ্যান্টিবায়ােটিকের টেস্ট দিলে দেখা। যায়, রােগীর শরীরে অ্যান্টিবায়ােটিক অকার্যকর বা রেজিস্ট্যান্স হয়ে গেছে। তারপর আরও ২০টি টেস্ট দিলে। দেখা যায় সেগুলােও অকার্যকর তার শরীরে। এরপর সব অ্যান্টিবায়ােটিক টেস্ট দিয়ে দেখা যায় কোনাে । অ্যান্টিবায়ােটিকই তার এরপর
কাজে আসছে না কাজ করছে না। এর মধ্যে তার পায়ের মাংসের পচন হাড় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে তার পা কেটে বাদ দিতে হবে। পরে তার পায়ের মাংস কেটে ফেলতে হয়েছে। শুধু এই একজন রােগী নন, অ্যান্টিবায়ােটিক রেজিস্ট্যান্স রােগী এখন নিয়মিত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অ্যান্টিবায়ােটিকের অপব্যবহার রােগীদের এই মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। অযৌক্তিক, অপ্রয়ােজনীয় ও যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ অ্যান্টিবায়ােটিক অকার্যকর হয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, দেশে বিদেশে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে জীবাণু অ্যান্টিবায়ােটিক প্রতিরােধী হয়ে উঠছে।
একের পর এক অ্যান্টিবায়ােটিক ব্যবহার করেও রােগী সুস্থ হচ্ছে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অ্যান্টিবায়ােটিকের অকার্যকারিতা মহামারির মতাে বিপজ্জনক। এ কারণে একটি দেশের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের অগ্রগতি
মন্থর হয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে। অ্যান্টিবায়ােটিক অকার্যকর হয়ে পড়লে সংক্রামক রােগের বিরুদ্ধে কোনাে প্রতিরােধব্যবস্থা থাকবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়ােটিক কিনে সেবন করলে এবং চিকিৎসকের দেওয়া অ্যান্টিবায়ােটিকের কোর্স সম্পন্ন না করলে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়।
গত মে মাসে দেশের অ্যান্টিবায়ােটিক পরিস্থিতি নিয়ে সভা হয়েছে। ওই সভায় ঔষধ প্রশাসন। অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এস এম সাবরিনা ইয়াসমিন বলেন, দেশের ফার্মেসিগুলােয় যারা কাজ করেন তাদের অনেকেরই অ্যান্টিবায়ােটিক নিয়ে ধারণা কম। আট বিভাগের ৪২৭টি ফার্মেসির ওপর জরিপ করে দেখা গেছে, ৬৭ শতাংশ কর্মী অ্যান্টিবায়ােটিক সম্পর্কে জানেন না।
মানুষ কিনতে চাইলেই তারা অ্যান্টিবায়ােটিক দিয়ে দেন। অ্যান্টিবায়ােটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার কমাতে ও সহজে অ্যান্টিবায়ােটিক চেনাতে ওষুধের মােড়কে লাল রং ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঔষধ। প্রশাসন অধিদপ্তর। অ্যান্টিবায়ােটিকের অপব্যবহার ঠেকাতে আইন করছে সরকার। এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মাে. আইয়ুব হােসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অ্যান্টিবায়ােটিকের অপব্যবহারে জীবাণু অপ্রতিরােধ্য হয়ে উঠছে।
আমরা এ বিষয়ে জরিপ পরিচালনা করেছি। দেশব্যাপী সচেতনতামূলক কাজ করা হচ্ছে। অ্যান্টিবায়ােটিক চেনাতে মােড়কে লাল রং ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। অ্যান্টিবায়ােটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার ঠেকাতে আইন হচ্ছে। এর খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংপর্যায়ে রয়েছে। দ্রুতই জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হবে।’ প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়ােটিক বিক্রি করলে ২০ হাজার টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
আইইডিসিআর ও আমেরিকান সােসাইটি ফর মাইক্রোবায়ােলজি ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এবং ২০২১ সালের জুন-জুলাইয়ে ১০টি হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের রােগীদের দেওয়া অ্যান্টিবায়ােটিক ও সেগুলাের কার্যকারিতা পরীক্ষা ও পর্যালােচনা করেছে। হাসপাতালগুলাের মধ্যে আছে- স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ। মিটফোর্ড হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজেস, রাজশাহী।
মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহীর ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ শামসুদ্দিন। আহমেদ হাসপাতাল। গবেষকরা ২০১৭-১৯ সালের মধ্যে ৭ হাজার ৪৮৫ ও ২০২১ সালের জুন-জুলাইয়ে ৭ হাজার ৬৫৮ জন রােগীকে দেওয়া অ্যান্টিবায়ােটিক পর্যালােচনা করেছেন। তাতে দেখা গেছে ১০টি অ্যান্টিবায়ােটিক সবচেয়ে বেশি। ব্যবহার করা হয়েছে।
এ তালিকায় আছে- সেফট্রিয়াক্সোন, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, সিপ্রােফ্লোক্সাসিন, ক্লোক্সাসিলিন, মেরােপেনেম, সেফিক্সিম, অ্যামােক্সোসিলিন + ক্যালভুলানিক অ্যাসিড, সেফুরােক্সিম, মােস্কিফ্লোক্সাসিন ও মেট্রোনিডাজোল। এর
মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় সেফট্রিয়াক্সোন। অ্যান্টিবায়ােটিকটি ৩৬ শতাংশের বেশি রােগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মাে. সায়েদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অ্যান্টিবায়ােটিক রেজিস্ট্যান্স পরবর্তী মহামারি। হিসেবে দেখা দেবে। অ্যান্টিবায়ােটিক অকার্যকর হতে থাকলে মানুষের চিকিৎসায়। কোনাে অ্যান্টিবায়ােটিক হাতে থাকবে না। নতুন কোনাে অ্যান্টিবায়ােটিক আবিষ্কার।
হওয়া পর্যন্ত মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠবে। তাই অ্যান্টিবায়ােটিক কম ব্যবহার। করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শমতাে যে কদিন সেবন করতে বলবেন তা সম্পন্ন করতে হবে। এর যথেচ্ছ ব্যবহার বিপদ ডেকে আনবে।’ অ্যান্টিবায়ােটিকগুলাে ঠিকমতাে কাজ করে কি না তা-ও পরীক্ষা করেছেন গবেষকরা। তারা দেখেছেন, সরকারি হাসপাতালে ৭৬ শতাংশ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা সেফট্রিয়াক্সোন কাজ করে না।
বেসরকারি হাসপাতালে তা ৪৩ শতাংশ। এভাবে প্রায় প্রতিটি অ্যান্টিবায়ােটিকের কমবেশি অকার্যকর হওয়ার প্রমাণ গবেষকরা পেয়েছেন। অ্যান্টিবায়ােটিকের অকার্যকারিতা রােধ করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওষুধটির পর্যায়ক্রমিক ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিল। ২০১৯ সালে সংস্থাটি এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত অ্যান্টিবায়ােটিকগুলােকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করে। প্রথমে ‘অ্যাক্সেস’ শ্রেণি।
এ শ্রেণির অ্যান্টিবায়ােটিকগুলাের অকার্যকর হওয়ার প্রবণতা কম। এগুলাে সাধারণত বেশি। ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘ওয়াচ’ শ্রেণির অ্যান্টিবায়ােটিকগুলাে ব্যবহার করা যাবে, তবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। আর রিজার্ভ’ শ্রেণির অ্যান্টিবায়ােটিক ব্যবহার করতে হবে মরণাপন্ন রােগীদের ক্ষেত্রে বা আইসিইউতে। আইইডিসিআর ও আমেরিকান সােসাইটি ফর মাইক্রোবায়ােলজির গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালগুলােয় ‘অ্যাক্সেস’ শ্রেণির অ্যান্টিবায়ােটিক ব্যবহার করা হয়েছে ২৮ শতাংশ। ওয়াচ’ শ্রেণির ব্যবহার হয়েছে দ্বিগুণের বেশি।
এই শ্রেণির অ্যান্টিবায়ােটিক ব্যবহার হয়েছে ৬৯ দশমিক ৪ শতাংশ। রিজার্ভ শ্রেণির অ্যান্টিবায়ােটিক শূন্য। দশমিক ৮ শতাংশ ব্যবহার হতে দেখা গেছে। আইসিইউতে থাকা রােগীদের অ্যান্টিবায়ােটিক দিতে সবচেয়ে বেশি বিপত্তি বাধছে। অ্যান্টিবায়ােটিক রেজিট্যান্স রােগীর হার অনেক বেশি।
অ্যান্টিবায়ােটিক কাজ না করায় রােগীর পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে না। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযােগী অধ্যাপক ও আইসিইউ ইনচার্জ ডা. মাে. আনিছুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, “আমাদের হাসপাতালের আইসিইউতে রােগী এলে প্রয়ােজনীয় টেস্ট করে ওষুধ প্রয়ােগ শুরু করি।
কিন্তু ব্লাড বা ইউরিন কালচার করে দেখা যায় রােগী অ্যান্টিবায়ােটিক রেজিট্যান্স পরীক্ষায় যে ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায় তা যে অ্যান্টিবায়ােটিকে নির্মূল হওয়ার কথা, তা হয় না। এর কারণ সরকারি হাসপাতালে আসার আগে অধিকাংশ রােগী বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে থাকেন।
সেখানে এত অপ্রয়ােজনীয় পরিমাণ ও বেশি মাত্রার অ্যান্টিবায়ােটিক দেওয়া হয় যে পরবর্তীতেও সব ওষুধ আর রােগীর শরীরে কাজ করে না। আবার অনেক রােগীও চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধের ডােজ পূর্ণ করেন না কিংবা পরামর্শ ছাড়া ওষুধ কিনে সেবন করেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে আইসিইউতে অনেক রােগীর কোনাে অ্যান্টিবায়ােটিকই কার্যকর হয়।
। চোখের সামনে রােগীর পরিস্থিতি খারাপ পর্যায়ে চলে যায়। অ্যান্টিবায়ােটিক ব্যবহারে সচেতন না হলে অসুস্থ হলে চিকিৎসার কোনাে পথ থাকবে না।’
- এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।